যুগের সাহিত্য গল্প

 


শ্রাবন্তীর নীল কষ্ট 

কাজী নাজরিন 


সারাদিনের ক্লান্তি শেষে শ্রাবন্তীকে বাসর ঘরে নেয়া হলো। একদম অজানা অচেনা মানুষের সাথে শ্রাবন্তীর বিয়ে হয় পারিবারিক ভাবে।হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হওয়াতে বরের সাথে শ্রাবন্তীর জানা শোনা কিছুই হয়ে ওঠেনি।শুধু আংটি পরানোর সময় একটু দেখেছে এতটুকুই। গ্রামের মেয়েদের বেশিরভাগ বিয়ে এভাবেই হয়ে থাকে। যেখানে নিজের চাওয়া পাওয়া বলতে কিছু থাকে না।পরিবার যা ভালো মনে করে সেটাই হয়।যাইহোক বাসর ঘরে শ্রাবন্তী বসে আছে হঠাৎ শাওন রুমে ঢুকেছে।রুমে ঢুকতেই শাওনের মুখে মিষ্টি হাসির আভা ফুটে উঠেছে। শ্রাবন্তী লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। শাওন রুমে ঢুকেই ইতস্ততভাবে বলতে লাগলো, ম্যাডাম আপনার পাশে বসতে পারি?শ্রাবন্তী মুখে কথা না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সাড়া দিলে শাওন শ্রাবন্তীর পাশে এসে বসে।শাওন একের পর এক শ্রাবন্তীকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করে কিন্তু শ্রাবন্তীর মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।এরপর শাওন বলতে লাগলো, আচ্ছা বুঝতে পেরেছি মা বাবাকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে তাই মন খারাপ যেটা আসার সময় কান্না দেখেই বুঝতে পেরেছি। শাওন এবার বললো, আচ্ছা কথা বলতে হবে না ঘুমিয়ে পরো।এই বলে শাওন শ্রাবন্তীর মাথায় হাত দিয়ে বলে,দেখো মন খারাপ করবে না কিন্তু তুমি এখানে নিজের বাড়ির মতোই থাকবে। আমি কখনো তোমাকে অবহেলা করবো না। এবার শ্রাবন্তী মুচকি হাসি দিলে শাওন শ্রাবন্তীকে বুকে জড়িয়ে নেয়।শ্রাবন্তী আধো আধো ভাবে শাওনের সব কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। দুষ্টু মিষ্টি কথা আর খুনসুটিতে রাত চারটে বেজে গেল যেটা দুজনের কেউ-ই টের পায়নি,,,  

ফজরের আযান কানে ভেসে আসছে আর এতক্ষণে শ্রাবন্তী আর শাওন বুঝতে পেরেছে রাত শেষ হয়ে এলো তাদের কথায় কথায়।দুজনেই চমকে উঠে বলে হায় আল্লাহ আযান দিয়েছে অথচ আমরা একটুও ঘুমাইনি। অথচ দুজনেই অনেক জার্নি করে এসেছে গতকাল। দুজন মিলে নামাজ পড়ে এবার ঘুমিয়ে পড়লো।ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির কাঁটায় চোখ পড়াতে শ্রাবন্তীর লজ্জার শেষ নেই।কিভাবে এখন এতো বেলা করে রুম থেকে বেরিয়ে শাশুড়ী মাকে মুখ দেখাবে,,।যাইহোক শাওন বলল, সমস্যা নেই আব্বা আম্মা বুঝতে পারবেন। এরকম মধুর বাসর উনারাও পার করে এসেছেন। 
শাবন্তী রুম থেকে বেরিয়ে যেই মাত্র রান্নাঘরের দিকে পা রাখলো, অমনি শাশুড়ী মায়ের চেহারায় মেঘের ঘনঘটা দেখতে পেলাে।শাশুড়ী মা চুপ না থেকে বলেই ফেললেন, এই বুঝি তোমার মায়ের দেয়া শিক্ষা? আরও বলতে লাগলেন, রাতের বেলা কি না ঘুমিয়ে চোর পাহারা দিয়েছিলে? কই আমার ছেলে তো আগে কখনো এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠে
নি,,,।শ্রাবন্তীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ছে।মনে মনে ভাবছে আহা এই মধুর রাতের শেষে এই কি শুনছি,,,। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, দেখুন মা আর কখনো এমন হবে না।আমাকে ক্ষমা করুন মা।এতক্ষণে রান্নাঘরের দিকে আসলো শাওন। শাওন বলতে লাগলো, মা নাস্তা খাবো।শাওন আরও বললো, শ্রাবন্তী আসো একসাথে নাস্তা খাবো।যাইহোক নাস্তা শেষে শ্রাবন্তী শাশুড়ী মায়ের সাথে সাথে এটা ওটা করার চেষ্টা করতে লাগলো যাতে অন্তত শাশুড়ী মা খুশি থাকেন।

বিয়ের বয়স দুমাস চলছে এদিকে শ্রাবন্তী মা হতে যাচ্ছে। শাওনের আনন্দের শেষ নেই।শ্রাবন্তীর শরীর যতই খারাপ থাক না কেন খুব ভোরে উঠে শশুর শাশুড়ী, 
দেবর,ননদ সবাইকে নাস্তা বানিয়ে খাওয়াতে হয়।এর মধ্যে কিছু এদিক ওদিক হলে শাশুড়ী মায়ের বকাঝকা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।তবে উচ্চ শিক্ষিত শশুর বাবা শ্রাবন্তীর উপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট। শশুর বাবা পছন্দ করেই ছেলের সাথে শ্রাবন্তীর বিয়ে দিয়েছেন। শশুর বাবা শ্রাবন্তীকে খুব সুন্দর করে মা বলে ডাকতেন। দেবর, ননদ সবাই শ্রাবন্তীকে পেয়ে খুব খুশি। শাশুড়ী মায়ের বকাঝকা, এটা ওটা বলা পরিবারের কেউ-ই পছন্দ করে না।শাওন তো রীতিমতো শ্রাবন্তীর হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চায় মায়ের কথাগুলোতে যেনো শ্রাবন্তী কষ্ট না পায়।শাওন, শ্রাবন্তীকে শপিং করতে নিয়ে গেছে এটা নিয়েও নানান সমস্যা শাশুড়ী মায়ের। শাড়ী পরতে কষ্ট হয় বলে শাওন, শ্রাবন্তীর জন্য বেশ কয়েকটা ত্রিপিস কিনেছে যেটা দেখে শাশুড়ী মায়ের চোখ কপালে।ঘরের বউ শাড়ী ছাড়া আর কিচ্ছু পরতে পারবে না। এটা শাশুড়ী মায়ের কড়া আদেশ। হাতে চুড়ি,মাথায় কাপড়,কানের দুল এইসব তো দিয়েই থাকতে হবে।শাওন এইসব একদম পছন্দ করে না কিন্তু মায়ের উপর আবার একটা কথাও বলতে পারে না।শশুর বাবার এখনো চাকুরী আছে।সকাল সকাল শশুর বাবা এবং শাওন অফিসে যায় শ্রাবন্তীর হাতের চা নাস্তা খেয়ে।আর যাইহোক বিয়ের আগে রান্নাঘরে না যাওয়া শ্রাবন্তী শাশুড়ী মায়ের বকাঝকা খেয়ে খেয়ে রান্না শিখে গেছে,,,,,,

আজ শাওন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে শ্রাবন্তীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে।
শাওন মনে মনে ঠিক করেছে এই অবস্থায় শ্রাবন্তীকে মানসিক শান্তি দেয়া দরকার। মায়ের খারাপ ব্যবহার শ্রাবন্তীর মন খুব খারাপ হয়ে আছে যেটা শাওন টের পায়।শাওন খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে সেই সাত সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে রাত দশটার দিকে বাসায় আসে।অফিসের অনেক কাজ শাওনকে সামলাতে হয়।এদিকে ইদানীং বাসায় এসে দেখতে পায় শ্রাবন্তীর মন খুব খারাপ। বোবা স্বভাবের শ্রাবন্তী শাশুড়ীর টুকিটাকি এইসব শাওন কে বলে না কারণ শ্রাবন্তী দেখতে পাচ্ছে শাওনের কাজের চাপ অনেক বেশি।এর উপর ছুটির দিনে সারাদিন কাটে সংসারের যাবতীয় সব কাজ শেষ করে। বাজার করা থেকে শুরু করে পরিবারের সব দায়িত্ব শাওনের উপর। শ্রাবন্তীর দুচোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে যেটা শাওন বুঝতে পারে শ্রাবন্তীর ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না আর চিন্তিত লাগছে। গুরুগম্ভীর শাওন কিছু না বলে শ্রাবন্তীকে তৈরি হতে বলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য। শ্রাবন্তী তৈরি হয়ে যখনি শাশুড়ী মায়ের কাছে গিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে বলেছে,এমনি উনি শুরু করে দিয়েছে ঘ্যানঘ্যান,,। শাওন কিচ্ছু না বলে শ্রাবন্তীকে নিয়ে বের হয়ে যায়।
সিএনজি করে শাওন সোজা একটা রেস্টুরেন্টে চলে যায়।শ্রাবন্তী বলে উঠে, আমরা না ডাক্তারের কাছে যাবো? রেস্টুরেন্টে কেন? শাওন মুচকি হেসে বলে আজ তোমাকে রাতের শহর দেখাবো।ডাক্তার আসবে নয়টার পর। এর আগে আমরা দু'জন আজকে ইচ্ছেমতো ঘুরবো, আনন্দ করবো। শাওন আরো বলতে লাগলো, শ্রাবন্তী বাসায় গিয়ে কিচ্ছু বলার দরকার নেই,বলবে ডাক্তার আসতে দেরি করেছেন। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খেয়ে পাশে একটা শপিং মলে গেল দুজন। টুকিটাকি অনেক কিছু কিনে দিয়েছে শাওন শ্রাবন্তীকে।এদিকে একটা পার্ক এর সামনে বসে দুজন মিলে অনেক গল্প করেছে। মজার মজার কথা শেয়ার করেছে। শ্রাবন্তী যেনো আজ অনেকদিন পর মুক্ত আকাশের নিচে নিজেকে উন্মুক্ত করেছে। খুশিতে বারবার শাওনের দিকে তাকাচ্ছে আর গান গেয়ে যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট কন্ঠে।শাওন, শ্রাবন্তীর খোলা চুলে হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নিলো শ্রাবন্তীকে।মায়াবতী শ্রাবন্তীকে দেখে আজ শাওনের মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ শাওন। এতক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার এই মিষ্টি আলোয় শ্রাবন্তীকে খুব সুন্দর লাগছে।এমনিতেই শ্রাবন্তী অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।

আরো কিছুক্ষণ দুজন নিরিবিলি জায়গায় মন খুলে কথা বলে এবার রওনা করলো ডাক্তার এর চেম্বারের উদ্দেশ্যে। ডাক্তার শ্রাবন্তীর সবকিছু দেখে কিছু পরীক্ষা করতে দিলেন।আর নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তারের কাছে আসতে বললেন। শাওন কে বললেন, ভারী কাজ করতে দিবেন না, দুধ ডিমসহ খাবারে সচেতন থাকবেন। ঘুমের যেন কমতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। ডাক্তার শাওন কে আরো বললেন, নতুন বাবা হচ্ছেন, আপনার এখন অনেক দায়িত্ব।সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান চাইলে আপনার স্ত্রীর যত্ন নিতে হবে আপনাকে।শ্রাবন্তীর চোখের নিচের কালো দেখে ডাক্তার শ্রাবন্তীকে বললেন, আপনার চেহারা দেখে আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। একদম চিন্তা করবেন না, ঠিকঠাক মতো খাবেন আর ঘুমাবেন। হালকা হা্ঁটাহাঁটি করবেন।

রাত বারোটায় শাওন আর শ্রাবন্তী বাসায় ফিরেছে। এদিকে শ্রাবন্তী একটু দূর্বল হয়ে পড়েছে।সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে দেখে শাওন শ্রাবন্তীর হাত ধরে ধরে আস্তে আস্তে উপরে ছয় তলায় নিজেদের বাসায় উঠেছে।

আজ শুক্রবার। শ্রাবন্তী এলার্ম-ঘড়ির শব্দে ভোর পাঁচটায় উঠে যেতে চাইলে শাওন শ্রাবন্তীকে টেনে ধরে বলে ঘুমাও। উঠতে হবে না,আজ ছুটির দিন। শ্রাবন্তী শাওনের কথা না শুনে উঠে গেলো। শাওন, শ্রাবন্তীকে বলে দিয়েছে আজ ছুটির দিনে সে সব জামা কাপড় ধুয়ে দিবে।শ্রাবন্তী গোসল সেরে নামাজ পড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।ওয়াশরুমে কাপড় ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। নাস্তা বানানো শেষ হলে সবাই নাস্তা করলো। শ্রাবন্তীর ননদ, দেবর তারা ঘুম থেকে উঠেছে এগারোটার সময়। তারাও উঠে যে যার মতো নাস্তা করেছে। শ্রাবন্তী দুপুরের রান্না তৈরি করছে আর শাশুড়ী মা টুকিটাকি সাহায্য করছে।হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে শ্রাবন্তী দরজা খুলতে গেল। শ্রাবন্তী দেখতে পেলো মধ্যবয়সী সেই মহিলা যিনি আরও কয়েকবার এসেছিলেন। শাশুড়ী মা বলেছিলেন, এই মহিলা সাহায্য চাইতে আসেন। আজকে শ্রাবন্তীকে দেখে সেই মহিলা বলে 
উঠলেন,নতুন বউ তুমি আমার একটা কাজ বন্ধ করে দিলা।আরও বলতে লাগলেন, আগে এই বাসায় কাজ করতাম,বউ তোমাকে আনার আগের দিন খালাম্মা আমাকে বলে দিয়েছেন আর কাজ করাবেন না।তাও মনের টানে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যাই,,।এদিকে শ্রাবন্তীর শাশুড়ী ডাক দিলে শ্রাবন্তী রান্নাঘরে চলে যায়। সেই মহিলাও শ্রাবন্তীর পেছন পেছন রান্নাঘরে এসে যান।

শ্রাবন্তী ওষুধ খাওয়ার জন্য রুমে গেলে দেখতে পায় শাওন সব কাপড় ধুয়ে ফেলেছে। ফিসফিস করে শাওন, শ্রাবন্তীকে বলে,যাও এবার কাপড় গুলো তুমি শুকাতে দিয়ে দাও। কাউকে বলো না আবার আমি কাপড় গুলো ধুয়েছি।অন্যদিন ঘর মোছা কাপড় ধোয়া সব শ্রাবন্তীকে করতে হয়। শ্রাবন্তীর চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু টলটল করছিল শাওনের কান্ড দেখে।
আগামীকাল শ্রাবন্তীর আব্বা আসবে।সামনে ঈদ আর ঈদের সবকিছু নিয়েই শ্রাবন্তীর আব্বা আসবেন আর মেয়েকে নিয়ে যাবেন। শ্রাবন্তীর শাশুড়ী এদিকে বলা শুরু করে দিয়েছে, অমুকের ছেলের শশুর বাড়ি হতে এটা দিয়েছে, তমুক ওটা দিয়েছে এই সেই,,,।শ্রাবন্তী দেখতে পেলো,নতুন বেয়াইয়ের জন্য তেমন ভালো মন্দ রান্নার আয়োজন নেই।শাশুড়ী মায়ের উপর কেউ কিচ্ছু বলে না।শাওন মাকে বলেছিল মা,কিছু আনতে হবে শশুর বাবার জন্য? 
শাশুড়ী মা বললেন, বাসায় সবকিছু আছে আর কিছু লাগবে না।এইতো অন্য দিনের মতো রান্না হচ্ছে মুরগী, ডাল,দুটো সবজি আর ডিম।শ্রাবন্তী মনে মনে লজ্জায় শেষ কিন্তু কাউকে কিছুই বলতে পারছে না।বেলা দুটোর সময় শ্রাবন্তীর বাবা এসেছে।কিন্তু ননদের বাড়ির মেহমান আসলে বিশ বাইশ রকমের রান্নাও করতে শ্রাবন্তী বেশ কয়েকবার দেখেছে।যাইহোক শ্রাবন্তীর আব্বা সবকিছু নিয়ে এসে পরের দিন শ্রাবন্তীকে নিয়ে চলে গেলেন। শ্রাবন্তীর মা শ্রাবন্তীকে দেখে কান্না করে দিয়েছেন আর বলছেন কিরে আমার মেয়েটা এমন হয়ে গেলো কেন?চোখের নিচে কালচে দাগ আর চোখ দুটো যেনো গর্তে ঢুকে গেছে। মায়ের মন বলে হয়তো একটু বেশিই লাগছে,,,,,

শ্রাবন্তী বাবার বাড়িতে খুব আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। এদিকে শাওন শ্রাবন্তীকে দেখতে এসেছে দু'দিনের জন্য। দুজন মিলে শ্রাবন্তীর নানুর বাড়িতে ঘুরতে গেলো খুব মজা করেছে। শাওনের অফিস আছে আজকে সে শহরে নিজ গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। শ্রাবন্তী আরো কিছুদিন থাকবে।শ্রাবন্তীর মা চাচ্ছে শ্রাবন্তীকে বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত নিজের কাছে রেখে দিতে কিন্তু শাওন না করে দিয়েছে কারণ এই অবস্থায় গ্রামে থাকা ঠিক হবে না আর শাওনের মা এটা কখনো মানবেন না।শহরে খুব দ্রুত ডাক্তার পাওয়া যায় হাতের কাছে কিন্তু গ্রামে যেটা সম্ভব না।শাওন চলে যাওয়ার মুহূর্তে বারবার শ্রাবন্তীর দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে মাশাল্লাহ মাত্র কিছুদিন নিজের বাড়িতে এসে বউ আমার খুব সুন্দর হয়ে গিয়েছে। চোখেমুখে যেনো আলো ঝরছে।চোখের নিচের কালচে ভাব একদম চলে গেলো। শ্রাবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শাওন চলে গেলো। 

শাওনের মন খুব খারাপ লাগছে শ্রাবন্তীকে রেখে একা একা যেতে।গাড়িতে শাওনের মনে মনে বারবার শ্রাবন্তীর চেহারা ভাসছে। 
শাওন ভাবতে লাগলো চার মাসের বিবাহিত জীবন অথচ মনে হচ্ছে কত যুগ যুগ ধরে পরিচিত তারা দুজন। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও শাওন শ্রাবন্তীকে একদম মনের মতো বউ হিসেবে পেয়েছে। 

আজ দুমাস হলো শ্রাবন্তী তাদের বাড়িতে যদিও শাওন এর মাঝে দুবার শ্রাবন্তীকে দেখে এসেছে। আগামী কাল শাওন শশুর বাড়ি যাবে শ্রাবন্তীকে আনতে।শাওন আর শ্রাবন্তী শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।শ্রাবন্তীর মা আর শ্রাবন্তী বিদায়ের সময় অনেক কান্নাকাটি করেছে। শ্রাবন্তী গত দুমাস অনেক আনন্দে ছিলো আর এই মেয়েটা এমনিতেই বাড়ির অন্যদের চেয়ে একটু বেশি হাসিখুশি। হরেকরকম পিঠা,ফল,শুকনো অনেক কিছু শ্রাবন্তীর মা দিয়ে দিয়েছেন যাতেকরে শ্রাবন্তীসহ সহ সবাই রেখে রেখে খেতে পারে।

বাসায় এসে শশুর শাশুড়ী কে সালাম করলে শশুর বাবা খুব খুশি হয় শ্রাবন্তীকে দেখে।শশুর বাবা আনন্দে বলে উঠলেন, আমার ঘরের লক্ষী ফিরে এসেছে। আরও বলতে লাগলেন, মারে তুই যাওয়ার পর আমার পুরো ঘর কেন জানি খালি খালি 
লাগতো।দেবর ননদেরা ও খুশি। শ্রাবন্তীর শাশুড়ী মা যেনো শশুর বাবার এই কথা সহ্য করতে পারলেন না। মুখ ঘোমরা করে উনি নিজের রুমে চলে গেলেন।কিছুক্ষণ পর শাশুড়ী মা শ্রাবন্তীর আনা সবকিছু দেখে একটা আনন্দের হাসি দিলেন। 
শাওন এখন নিয়মিত শ্রাবন্তীকে নিয়ে রাতের বেলা ছাদে উঠে একটু হা্ঁটাহাঁটি করানোর জন্য। মাঝেমধ্যে চাঁদের আলোয় দুজন ছাদে অনেক খুনসুটি করে।আজ ছাদ থেকে বাসায় আসার পর শাওন কে ডেকে মা কড়া ভাবে বলে দিলেন আর যেন শ্রাবন্তীকে নিয়ে ছাদে না যায়।এমনকি এটাও বলে দিলেন ডাক্তার দেখানো ছাড়া এক মুহুর্তের জন্য যেন কোথাও না নেয়।
শেষ হয়ে গেলো ছাদে যাওয়া,,। 

শাওন সেই সকালে বেরিয়ে বাসায় আসে রাত দশটার দিকে। এখন আর রাতে শ্রাবন্তীকে নিয়ে ছাদে উঠে না।তবে দুজন মিলে যথেষ্ট আনন্দে থাকতে চেষ্টা করে যতক্ষণ বাসায় থাকে।এদিকে শ্রাবন্তীর শাশুড়ী মা খাবার দাবারে অনেক রুটিন করে দিয়েছে যেগুলো খেলে নাকি সমস্যা হবে। দুনিয়ার কুসংস্কার সব উনার ভেতরে। ছাদে গেলে সমস্যা, খাবারে সমস্যা, আরও কতো কি,,।শাওন এইসব একদম বিশ্বাস করে না,শ্রাবন্তীও, কিন্তু করার কিছু নেই মানতেই হয়।শ্রাবন্তী মাঝেমধ্যে ভাবতে থাকে, শশুর বাবা অশিক্ষিত বিয়ে করাতে মনে হয় এই অবস্থা। তবে শ্রাবন্তীর দাদুও অশিক্ষিত ছিলো কিন্তু উনার মন মানসিকতা অনেক উন্নত ছিলো যদিও গ্রামেই ছিলেন। তখনকার সময় আবার এরকম বিয়ে সবার হতো কারণ তখন মেয়েরা তেমন একটা শিক্ষিত ছিল না।শ্রাবন্তী আরো ভাবে নেপোলিয়ন, সেজন্যেই হয়তো বলেছে, "তোমরা আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও,আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দিব"।
তবে শ্রাবন্তীর শশুর পরিবারের আর কেউ কিন্তু এইরকম না,শশুর বাবার মন মানসিকতা অনেক উন্নত। কিন্তু সবাই শাশুড়ী মায়ের কথামতোই চলে। শ্রাবন্তী শাশুড়ী মায়ের মন ভালো থাকলে তখন মাথায় তেল কিংবা উকুন দেখার সময় খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক তথ্য জানতে পারে।শাশুড়ী মা মাঝেমধ্যে শ্রাবন্তীকে নিজের জীবনের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।শ্রাবন্তীর খুব কষ্ট হয় শাশুড়ী মায়ের জন্য। শ্রাবন্তীর শাশুড়ী মা সেই ছোট বেলায় মা বাবা হারিয়ে ফেলেছেন। এরপর অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে শশুর শাশুড়ী দ্বারা অনেক নির্যাতিত হয়েছেন, তিনি ভালো কিছু শেখার আসলে পরিবেশ পাননি। আর শশুর বাবাও আগে অনেক কষ্ট দিয়েছেন এখন শেষ বয়সে এসে উনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। 
তবে এখনো শশুর বাবার অভ্যাস ঠিকই আগের মতো আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। উনার যাবতীয় কাজ উনি নিজের হাতে কিচ্ছু করেন না সবকিছু শাশুড়ী মাকে দিয়ে করিয়ে নেন।এই যেমন, জুতা পরা,মোজা পরা,এইসব আবার খুলতেও শাশুড়ী মা লাগবে।এমনকি সামনে থাকা মগ থেকে পানি শাশুড়ী মা ঢেলে দিতে হবে,,,।শ্রাবন্তীর মাঝেমধ্যে জেদ হয় মনে মনে আর ভাবে এজন্যেই শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে।সারাদিন জি হুজুর জি হুজুর করা মানুষটার কথা না শুনেই বা কি করে?

আর সেজন্যেই শাশুড়ী মা চান শাওন ও সেরকম করুক বউকে দিয়ে।শশুর বাবা জীবনে শাশুড়ী মাকে নিয়ে চার দেয়ালের বাইরে বের হননি তাই তিনিও ছেলের বউয়ের এইসব সহ্য করতে পারেন না।উচ্চ শিক্ষিত শাওন আবার খুবই উন্নত মন মানসিকতার অধিকারী সে এইসবে একদম নেই তবে মায়ের সামনে মাঝেমধ্যে অভিনয় করে,,

শ্রাবন্তীর সমস্ত শরীরে পানি এসে গেছে তাই শাওন শ্রাবন্তীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। শরীরের এমন অবস্থায়ও ঘরের সব কাজ করতে হচ্ছে আবার কাজের ভুল ধরিয়ে আজকাল শাশুড়ী মা খুব বকা দেয় 
 যাতেকরে শ্রাবন্তীর মানসিক শান্তি বলতে একদম নেই।শাওন একজন কাজের মানুষ আনবে বললে সেটা নিয়ে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। তবে শাওন আজকাল অনেক কাজ নিজে করে দেয়।পরিবারের অন্যরা কিছুদিন ভালো আচরণ করলেও এখন শাশুড়ী মায়ের সাথে মিলে সবাই মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। শশুর বাবা এখন আর শ্রাবন্তীকে মা করে ডাকেন না।অথচ এই অবস্থায় শ্রাবন্তীর খুব বেশি মানসিক শান্তিতে থাকার দরকার ছিলো
যেটা একদম পাচ্ছে না।শাশুড়ী মা ইতিমধ্যে খাবার কম খাওয়ার জন্য নানান ধরনের কথা বলে যাচ্ছেন, উনার মতে বেশি খাইলে বাচ্চা অতিরিক্ত বড় হয়ে যাবে যার কারণে ডেলিভারির সময় কষ্ট হবে,বিপদ হবে এই সেই,,।আজকাল শাশুড়ী মা শ্রাবন্তীর খাবার নিয়ে নানান সমালোচনা করে বেশি খাচ্ছে বলে।আর উনার এমন আচরণে শ্রাবন্তী আজকাল একটু খেয়ে উঠে যায়।খাবার কিন্তু শ্রাবন্তীর নিজে নিয়ে খাবার অধিকার নেই সেটা শাশুড়ী মায়ের হাতে।তবে শাওন লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে শ্রাবন্তীকে এটা ওটা এনে খাওয়ায়।
আগে সবার সাথে টেবিলে একসাথে খাওয়া হতো কিন্তু শশুর বাবা শ্রাবন্তীর খাবারে একটু আগ্রহ দেখাতে শাশুড়ী মা এখন শশুর বাবাকে সবার আগে খেতে দিয়ে দেন।আর শাওন এখন একবেলাও একসাথে খেতে পারে না।শাশুড়ী মা সুন্দর ভাবে পুরুষদের আলাদা খাবারের নিয়ম করেছেন। 

আগামীকাল শ্রাবন্তীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।এদিকে শ্রাবন্তীর মা, বাবা, ভাই বোন সবাই চলে এসেছে। পুরো শরীরে পানি এসে শ্রাবন্তীর অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার শ্রাবন্তীর অবস্থা দেখে বলেই দিলেন নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না।সিজারের সবকিছু ঠিকঠাক করা হলে হঠাৎ শ্রাবন্তীর খুব ব্যথা শুরু হয় ঠিক তখনই শ্রাবন্তীর নরমাল ডেলিভারিতে ফুটফুটে রাজকন্যার জন্ম হয়। চাচা, ফুফুরা , সবাই অনেক খুশি হলো। বাচ্চা নিয়ে সবার টানাটানি শুরু হলো কোলে নিতে।আহা কি আনন্দ শ্রাবন্তী আর শাওনের এবং শ্রাবন্তীর পুরো পরিবারের। এদিকে শ্রাবন্তীর শাশুড়ী মা মেয়ে সন্তান জন্ম হয়েছে শুনে সেই করুন সুরে বিলাপ করতে লাগলেন, উনার বংশের বাতি ছেলে না এসে মেয়ে এসেছে সেজন্য,,।
দেখতে দেখতে শ্রাবন্তীর মেয়ের বয়স এক বছর। এমন রাজকন্যাকে যে কেউ আদর না করে পারে না।নাতিনের জন্য দাদা কতকিছু কিনে আর কতো আদর করে যেটা ভাষায় বলে বুঝানো যাবে না।নাতিনের একটু কান্নার শব্দ শুনলে সবাই ছুটে আসে।নাতিন বলতেই দাদা দাদু সবাই অজ্ঞান। 
আজ শ্রাবন্তীর অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। শ্রাবন্তী ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে।
শ্রাবন্তীর মাস্টার্স ভর্তি নিয়ে হরেকরকম ঝামেলা যুক্ত হয়েছে। এতে কেউ রাজি নেই।এমনিতেই দিন দিন শ্রাবন্তীর কপাল থেকে শান্তি চলে যাচ্ছে। একদিকে ঘরের সব কাজ, বাচ্চার সবকিছু আবার বাচ্চা নিয়ে রাত জাগতে জাগতে শ্রাবন্তীর অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। নিয়মিত মাথাব্যথা, মাথাধরা খুব খারাপ হতে চলেছে শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা। শাওন এখন আর আগের মতো অতোটা খেয়াল করে না শ্রাবন্তীর। শ্রাবন্তীর জন্য শাওন কে নানাভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে শাশুড়ী মা। শাওন বউ পাগল হাবিজাবি এইসব বলে,শাওন দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবন্তীর কোন ব্যপারে সে এখন আগের মতো গুরুত্ব দেয় না,,।

শাওন আজকাল বাসায় ফিরে শ্রাবন্তীর সাথে তেমন একটা কথা বলে না।হয়তো বউ পাগল কথাটা শুনতে শুনতে এখন বিরক্ত এসে গেছে। শাওন বাহির থেকে এসেই মায়ের ঘরে চলে যায় আর সেখানে চলে শ্রাবন্তীকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা। শাশুড়ী মায়ের সাথে আজকাল শশুর বাবাও ভালো ভাবে গলা মেলান।দেবর ননদ তারাও থাকেন নিয়মিত এই আলাপ আলোচনায়।সবার পছন্দের সেই শ্রাবন্তীর এখন নানান সমস্যা তুলে ধরা হচ্ছে, যেমন, কাজেকর্মে, আচার-আচরণে, চেহারা,আরও কত কি,,।মনে হয় শ্রাবন্তীর মতো বিশ্রী আর বাজে মেয়ে পুরো দেশে আরেকটা নেই।যেমন আচরণ শুরু হয়েছে মনে হয়,উনারা সবাই সরকার দল আর শ্রাবন্তী বিরোধী দল।যাদের দলে যুক্ত হয়েছে আজকাল শাওন। অথচ এই সেই মেয়েকে এক দেখাতে সবাই পছন্দ করেছে আবার বাসায় আসার পরও সবাই খুব খুশী ছিলো। সেই হাসিমাখা মেয়েটা কতদিন মনখুলে হাসে না,শ্রাবন্তী হাসতে ভুলে গেছে,,,,।শ্রাবন্তী হাসে না মুখ ভার করে রাখে সেটাও তাদের সমস্যা। একটা মানুষ কতোটা মানসিক যন্ত্রণায় থাকলে হাসতে ভুলে যায় সেটা কি কেউ জানে?

হৈমন্তী গল্প এখন শ্রাবন্তীর মনের আঙিনায় বারবার দোল খেতে থাকে।শ্রাবন্তী ভাবতে থাকে রবীন্দ্রনাথের সেই হৈমন্তী গল্প আজও বাংলার ঘরে ঘরে বিদ্যমান। শুধুমাত্র সমাজ এবং পরিবারের কথা ভেবে নারী নীরবে সবকিছু সহ্য করে যায়।শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক কেউ-ই নারীর সঠিক মূল্যায়ন করে না।শ্রাবন্তীর উচ্চ শিক্ষিত ঘরে বিয়ে হয়েছে আবার উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে অথচ তাকে নীরবে হার মানতে হচ্ছে। এই সমাজেও সেই আগের নিয়ম কানুন সবই চলছে যেটা অনেক আপন মানুষও টের পাচ্ছে না।

শ্রাবন্তীর বড় বোনেরা সবাই অনেক সুখী আর সে লজ্জায় শশুর বাড়ির এইসব কারো সাথে শেয়ার করে না কিন্তু শ্রাবন্তীর চেহারা দেখে যে কেউ অনুমান করতে পারে সে ভালো নেই,,

দেখতে দেখতে শ্রাবন্তীর বিয়ের বয়স আজ 
সাত বছর পূর্ণ হলো।অনেক চড়াই 
উৎরাই পেরিয়ে শ্রাবন্তী এখন কিছুটা ভালো আছে। এর মধ্যে শ্রাবন্তীর এক ননদের বর মারা গেলে সে এখানে তিন বছর ছিলো। সেই ননদ তিনটা বাচ্চা নিয়ে উঠেছিল শ্রাবন্তীদের বাসায়। আর সেই ননদ শ্রাবন্তীর জীবন তিলে তিলে শেষ করে দিয়ে তারপর গিয়েছে আবার নিজের জায়গায়। শাশুড়ী মায়ের সব স্বভাব সেই ননদ পুরোটাই পেয়েছে। শ্রাবন্তীর সংসার ভেঙে দিতে শাশুড়ী আর ননদ মিলে নানান কাহিনী করেছে যেগুলো ভাবতেই শ্রাবন্তীর কান্না আসে। এরমধ্যে ননদ যাওয়ার এক বছরের মাথায় বিয়ে হলো শ্রাবন্তীর মেজো দেবরের।পাঁচ মাসের মাথায় শ্রাবন্তীর সেই দেবর আলাদা বাসায় বউকে নিয়ে চলে গেছে। এরমধ্যে শ্রাবন্তীর শাশুড়ী ও সে বউয়ের সাথে অনেকবার ঝামেলা হয়েছে। বউ মাশাল্লাহ শাশুড়ী মায়ের চেয়ে কোন অংশে কম না।তাইতো সে চলেই গেলো। কিছুদিন পর শ্রাবন্তীর আরেক দেবরের বিয়ে হবে। নানান আয়োজন চলছে।মহা ধুমধামে বিয়ে হলো। শাশুড়ী মায়ের গলার স্বর অনেকটা কমে এসেছে কিন্তু শ্রাবন্তীর কাছে উনি ঠিকই আগের মতন। নরম স্বভাবের মানুষ হলে যা হয় আরকি।নতুন বউ বাসায় আসার পনেরো দিনের মাথায় তুমুল ঝগড়া হলো নতুন বউয়ের সাথে শাশুড়ী মায়ের! 

শ্রাবন্তীর সামনে সেই ভয়ংকর শাশুড়ী কে খুব অপমান করে ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলো নতুন বউ।কিছুটা হলেও শাশুড়ী মায়ের টনক নড়লো। 

শ্রাবন্তী আবার মা হতে চলেছে। এখন শ্রাবন্তীর কদর আবার বেড়ে গেলো। পরপর দুই বউয়ের সাথে ঝামেলা করে সুবিধা করতে না পারা শাশুড়ী মায়ের শেষ ভরসা এখন শ্রাবন্তী।শ্রাবন্তীকে এখন শাওন আবার নতুন করে ঠিক আগের মতো ভালো বাসে এবং মাঝেমধ্যে ঘুরতে নিয়ে যায়।শ্রাবন্তী যেনো অনেক বছর পর নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। 

দেখতে দেখতে শ্রাবন্তীর ছেলে মেয়ে বড়ো
হয়ে যাচ্ছে। এদিকে হঠাৎ একদিন শ্রাবন্তীর শশুর অসুস্থ হয়ে পরপারে চলে গেলেন। আর সেই মুহূর্তে শ্রাবন্তীর শাশুড়ী মায়ের নিজের করা ভুলের জন্য শ্রাবন্তীকে বুকে জড়িয়ে ধরে করুন কান্না। শাশুড়ী মা বারবার শ্রাবন্তীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে সবার সামনে।শ্রাবন্তীও সেদিন অনেক কান্না করেছে শাশুড়ী মায়ের এমন আহাজারি দেখে।সব হারিয়ে শাশুড়ী মায়ের শেষ ভরসা এখন শ্রাবন্তী আর শাওন। 

শ্রাবন্তী আর ঘরকুনো হয়ে চার দেয়ালে বন্দী হয়ে থাকতে চায় না।শাওন কে নিজের অনুভূতির কথা জানালে শাওন সহমত প্রকাশ করে। শ্রাবন্তী অনেকগুলো চাকুরিতে আবেদন করতে লাগলো। হঠাৎ শ্রাবন্তী ভালো একটা চাকুরী করার সুযোগ পেয়ে গেলো। শাওন মিষ্টি এনে সবাইকে শ্রাবন্তীর খুশির খবর দিলো।শাশুড়ী মায়ের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে।তিনি শ্রাবন্তীর চাকুরী কোন অবস্থায় মেনে নিতে পারছেন না।

শ্রাবন্তী এদিক ওদিক চিন্তা না করে চাকুরীতে যাওয়া শুরু করেছে। ঘরের কাজ সামলে শ্রাবন্তী নিয়মিত অফিস যাচ্ছে। 
রাগে ক্ষোভে শাশুড়ী মা অন্য ছেলের বাসায় গিয়ে উঠেছে যদিও সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি,,

শ্রাবন্তীর ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে তারা মাকে অনেক সহযোগিতা করে। শ্রাবন্তী ইতিমধ্যে একজন সাহায্যকারী রেখেছে বাসায়। শ্রাবন্তী এতোদিন পর বুঝতে পেরেছে মানুষ হলো শক্তের ভক্ত নরমের যম।তাই কখনো একদম নরম হওয়া উচিত নয়।আর মেয়েদের সবার আগে পায়ের নিচে মাটি ঠিক রাখতে হবে।পুরুষদের করুনা নিয়ে কখনো সুন্দর ভাবে জীবন কাটানো যায় না।জীবন চলে যায় কিন্তু নিজের শখ আহলাদ সব মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। শ্রাবন্তী মাঝেমধ্যে চিন্তা করে মেয়েদের নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী যেকোনো কিছু করা দরকার তা না হলে তিলে তিলে জীবন শেষ হয়ে যায়। যত শিক্ষিত হোক গৃহিণী হলে তাকে কেউ মূল্যায়ন করে না। শিক্ষার কদর এখানে নেই,থাকে না কোন স্বাধীনতা। শ্রাবন্তী একসময় লেখালেখি করতো।শ্রাবন্তী এখন আবার নতুন করে লেখালেখি শুরু করেছে। শ্রাবন্তীর মনের ভেতর জমাটবাঁধা কষ্ট গুলো শ্রাবন্তী লিখে স্বস্তি ফিরে পায়।

শ্রাবন্তী অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত নারীদের নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে।
যেগুলো পত্রিকায় পাঠানো হলে দেশ সেরা অনেক পত্রিকায় সেগুলো নিয়মিত ছাপানো হয়।এতে শ্রাবন্তী লেখালেখির জগতে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। শাওন, শ্রাবন্তীকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে।যে শাওন একসময় মায়ের কথামতো শ্রাবন্তীকে ঘর থেকে বের করে দিতেও রাজী ছিলো এখন তার অনেক পরিবর্তন এসেছে। শ্রাবন্তী বুঝতে পারে এইসব হলো অবস্থানের জন্য। নিজের শক্ত অবস্থান থাকলে সবাই পক্ষে থাকে পক্ষান্তরে দূর্বলের পক্ষে কেউ থাকে না। 

আজ শ্রাবন্তীর সব হয়েছে বলে শাশুড়ী মা ও শ্রাবন্তীর পক্ষে সুন্দর সুন্দর বচন দেন।শ্রাবন্তী ভাবতে থাকে,একটা সময় ঝড়ের রাতে যে শাশুড়ী মা শ্রাবন্তীকে ঘর থেকে বের দেন সেদিন শ্রাবন্তী যে-ই না ছাদ থেকে লাফ দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে শাওন শ্রাবন্তীকে ধরে ফেলে।তখন শ্রাবন্তীকে দেখতে শ্রাবন্তীর বাবার বাড়ির কেউ আসতো না শ্রাবন্তীর শাশুড়ী মায়ের খারাপ ব্যবহারের জন্য। এখন শ্রাবন্তীর সব হয়েছে আর সবাই এখন শ্রাবন্তীর খবর নেয়,দেখতে আসে,এটা ওটা আনে।শ্রাবন্তী নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারে, 
দুনিয়াতে দুখের সাথী কেউ হতে চায় না,দুখের গল্প কেউ শুনতে চায় না,এমনকি দুখের সময় কেউ-ই পাশে থাকে না।দুনিয়াতে সবাই সুখের সাথী শুধুমাত্র মা বাবা ছাড়া। মা বাবা কিচ্ছু করতে না পারলেও অন্তত দুহাত তুলে নামাজের মোনাজাতে দোয়া করেন।সন্তানের জন্য চোখের জল শুধুমাত্র মা বাবা-ই বের করেন। কষ্টের সময় শ্রাবন্তীর মায়ের একটাই শান্তনা বাক্য ছিলো, ধৈর্য ধর মা ধৈর্য ধর।মায়ের জন্যেই শ্রাবন্তীর নড়বড়ে সংসার টিকে যায়।আজ সুখের দিনে শ্রাবন্তীর বারবার মাকে খুব বেশি মনে পড়ে। শ্রাবন্তীর শাশুড়ী যেখানে যেকোনো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংসার ভেঙে দিতে চায় সেখানে শ্রাবন্তীর মা পুরো উল্টো। আর সেজন্যেই শ্রাবন্তীর চোখের সামনে শাশুড়ী মা অনেক অনেক কর্মের ফল পেয়েছেন। 

পাপের ফল দুনিয়াতে বেশিরভাগ ভোগ করে যেতে হয়।শ্রাবন্তী নারীদের নিয়ে আশপাশের ঘটে যাওয়া সমগ্র চিত্রগুলো তুলে ধরেন লেখালেখির মাধ্যমে। শ্রাবন্তীর ধারণা তার এইসব লিখার মাধ্যমে যদি একটা মেয়ের ও উপকার হয় তাতেই তার শান্তি। 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন

তানকা/স্বপন শর্মা