ধারাবাহিক গল্প লজিং মাস্টার || গোলাপ মাহমুদ সৌরভ

 ❑

ধারাবাহিক গল্প

পর্ব ০১

লজিং মাস্টার

গোলাপ মাহমুদ সৌরভ

সোহান সবেমাত্র স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছে। সে একজন মেধাবী ছাত্র বলা যায় কারণ এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। পড়াশোনা অত্যন্ত মনোযোগী। বাবা-মা যেমনটা আদরের সহিত তাঁকে বড়ো করে তুলেছে তেমনই শিক্ষকরাও খুবই যত্ন সহকারে তাকে আদর্শ ছাত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। অধিক দেহের অধিকারী না হলেও সুস্থ সুন্দর স্মার্ট বালক বলা যায়, সব সময় নিজেকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে খুব পছন্দ করে সোহান। নম্রতা ভদ্রতা বজায় রেখে সোহান চলাফেরা করে সে জানে কীভাবে বড়দের সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ করতে হয়। মনে তার একটাই স্বপ্ন বড় হয়ে একজন ভালো ডাক্তার হয়ে গ্রামের দুস্থ অসহায় গরীব মানুষদের চিকিৎসা করে মানব সেবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। আসলে সেবাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। তবে এমন শিক্ষাই গ্রহণ করা উচিত যে শিক্ষা মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ কে জাগিয়ে তোলে একজন সমাজ সেবক হয়ে অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা যায়। সমাজে মানুষের অভাব হয়না তবে ভালো মানুষের অভাব আজও কমই দেখা যায়।
সোহান বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। মা স্কুল শিক্ষিকা বাবা রহিম উদ্দিন ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সোহানের বাবা দেশের জন্য মানুষের জন্য জীবন দিয়ে সুন্দর একটি বাংলাদেশ নামক মানচিত্র আনতে যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমনই একটি স্বাধীন দেশ-ও আমাদের কে উপহার দিয়ে গেছে। বাবার আদর্শেই সোহান বড় হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। বাবার মুক্তিযুদ্ধার ভাতা দিয়েই মা কোন রকম সংসার চালান এবং সোহান পড়াশোনা করে। মা আয়েশা বেগম অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। সোহান নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করার জন্য ঢাকা হোস্টেলে থাকে। কিছু দিন যাওয়ার পর সোহান যখন ঢাকার অলিগলি চিনতে এবং বুঝতে পেরেছে তখনই একটি চিন্তা মাথায় এলো এতো টাকা খরচ করে হোস্টেলে থাকি যদি কারো বাসায় লজিং থাকা যায় তাহলে বাড়িতে মায়ের একটু কষ্ট দূর হবে আর আমার জন্য প্রতি মাসে টাকা জোগাড় করে পাঠাতে হবে না। তারপর সোহান কলেজের আশেপাশে লজিং খুঁজতে শুরু করলো কিছুদিন পরেই মাথায় আইডিয়া এলো কীভাবে লজিং থাকা যায়। হঠাৎ সোহানের এক বন্ধুর সাথে বিকেলে চায়ের আড্ডায় বসে আলাপ করলো কীভাবে লজিং পাওয়া যায় তাকে বুদ্ধি দিলো কম্পিউটার দোকানে গিয়ে লজিং থেকে" আপনার সন্তান কে পড়ার চাই" এমন একটি বিজ্ঞাপন লিখে প্রিন্ট কপি বাহির করে স্কুলের আশেপাশের দেয়ালে লাগিয়ে দিতে। বন্ধুর কথামতো পোষ্টার লাগানো হলো। কিছুদিন পরেই একটি অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে কল এলো, হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ওয়া আলাইকুম সালাম। কে বলছেন? জ্বি আমি খলিল বলছিলাম, আপনি কী সোহান বলছিলেন? জ্বি, বলুন। আমি আমার মেয়ের জন্য একজন ভালো শিক্ষক খুঁজছিলাম বিজ্ঞাপন দেখে কল দিলাম। হ্যা বলুন, আমি কী করতে পারি। আমার বাসা নটরডেম কলেজ থেকে একটু দূরে পায়ে হেঁটে আসতে পাঁচ মিনিট লাগবে। ঠিক আছে বলুন কখন আসবো। কাল বিকেলে আসুন। ওকে, আসবো। দুজনেই কল কেটে দিলো। পরের দিন বিকেল বেলা সোহান হাজির হলো খলিল সাহেবের বাসা কলিং বেল চাপতেই একজন ভদ্র মহিলা এসে দরজা খুললেন। সোহান সালাম দিয়ে পরিচয় দিলো তারপর ভদ্র মহিলা সোহান কে ভিতরে আসার অনুমতি দিলো।
সোহান ওয়েটিং রুমে সোফা বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে খলিল সাহেব এসে সালাম দিয়ে আলাপ শুরু করলো। আচ্ছা সোহান আমি তোমাকে তুমি করেই বলি কারণ তুমি আমার ছেলের বয়সী। জ্বি বলুন সমস্যা নেই। তুমি নটরডেমে পড়ছো জানি খুব মেধাবী তুমি তবে লজিং থেকে পড়াশোনা করতে চাও কেন? দেখুন আঙ্কেল আমি খুবই সাধারণ ঘরের ছেলে তাছাড়া আমার বাবা নেই বাড়িতে মা একা থাকেন সংসারে উপার্জন ব্যক্তি নেই বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার পরিবর্তে এখন মা মুক্তিযুদ্ধা বাতা পায় আর এ টাকা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। নাম কী তোমার বাবার? রহিম উদ্দিন। বাড়ি কোথায় তোমাদের? ঢাকা জেলা। আচ্ছা, সেই রহিম উদ্দিনের ছেলে তুমি আরে তুমিতো জানোনা তোমার বাবা আর আমি একইসাথে আগরতলা ট্রেনিং নিয়েছি এমনকি একসাথে যুদ্ধ করছি প্রচন্ড সাহসী এবং দেশপ্রেমিক ভালো মানুষ ছিলেন তোমার বাবা। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম কিছুই বুঝতামনা মায়ের মুখে বাবার কথা শুনেছি। ঠিক আছে তুমি যেহেতু আমার বন্ধুর ছেলে আমার আর কিছু জানার নেই তুমি ইচ্ছে করলে কালই আসতে পারো। ঠিক আছে আঙ্কেল আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে,এতো তারাতাড়ি লজিং খুঁজে পাবো আর আপনার মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাছাড়া বড়কথা হলো আপনি আমার বাবার একজন ভালো বন্ধু ছিলেন। খলিল সাহেব তার স্ত্রী ও মেয়ে কে ডাকলেন। মা ও মেয়ে দুজনেই আসলো। দেখো ফাতেমা ওর নাম সোহান বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার সহপাঠী পাকিস্তানি ক্যাম্প উড়িয়ে দিতে গিয়ে নিজেই মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে মারা যান। ফাতেমা হলো খলিল সাহেবের স্ত্রী। এদিকে এসো মামণি ও আমার একমাত্র মেয়ে মিথিলা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আজ থেকে ও তোমার লজিং টিচার তার নাম সোহান।মিথিলা সালাম দিয়ে বললো কেমন আছেন স্যার। জ্বি ভালো আছি তুমি কেমন আছো? ভালো আছি। কিছুক্ষণ পর ফাতেমা বেগম নাস্তা নিয়ে এলেন সোহানের জন্য। সোহান নাস্তা খেয়ে বললো ঠিক আছে আঙ্কেল আগামীকাল আমি চলে আসবো। ঠিক আছে এসো তোমার কোন অসুবিধা হবে না। ওকে ভালো থাকবেন আসি। পরের দিন সকাল বেলা সোহান চলে এলো। খলিল সাহেব সোহানের জন্য একটা রুম খালি করে দিলো এটাতেই সোহান থাকবে। দুপুর বেলা সবাই একসাথে বসে খাবার খেলো। সোহান যে তাদের বাড়ির লজিং মাস্টার তা কেউ মনে করেনা বরং সবাই ভাবে সে-ও এ বাড়ির একজন। বিকেল বেলা মিথিলা স্কুল থেকে এলে তাকে ক্লাসে কী পড়ানো হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হলে বাড়িতে সোহান তাকে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয়। রাতের বেলা যখন সোহান মিথিলা কে পড়তে বলে তখন মিথিলা মুচকি হাসি দিয়ে বলে ভাইয়া তোমার কাছে পড়তে আমার খুব ভালো লাগে কারণ তুমি অতিসহজেই সব বিষয়ে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারো যেটা আমি ক্লাসে বুঝতে অসুবিধা হয় সেটা বাসায় তোমার কাছে বুঝতে পারি। ঠিক আছে মিথিলা তুমি মন দিয়ে পড়লে আশা করি তুমি একদিন ভালো রেজাল্ট করবা আর আমিও লজিং থেকে স্বার্থকতা খুঁজে পাবো তাছাড়া তোমার বাবা মা অনেক বেশি খুশি হবেন। ঠিক আছে স্যার আপনার কথা আমার মনে থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন

তানকা/স্বপন শর্মা